-
কাকে বলে সিনেমা? প্রথম খণ্ড
চলচ্চিত্রের ভাষা কখন একটি পরিণত রূপ লাভ করেছিল? তখন পর্যন্ত চলচ্চিত্র শৈলীর মূল বিতর্কগুলো কী ছিল? নাটক বা উপন্যাসের মতো প্রাচীন অভিব্যক্তিগুলোর সাথে চলচ্চিত্র কোন কানুনগুলোর ভেতর দিয়ে লেনদেন করে? অথবা আরো পিছিয়ে গিয়ে, ছবি কি বিশ্বাসের বাহন না কি বাস্তবের সূচক হয়ে উঠতে চায়? এই সংলাপে প্রাচীন ভাস্কর্য, চিত্রকলা আর আলোকচিত্র কীভাবে নিজের অবস্থানকে সংহত করে-কীভাবে প্লাস্টিক শিল্পের ইতিহাস পাঠ করব আমরা?
এই ভাবনাগুলো মূলগত। এদের স্তর-বিন্যাস বহুমাত্রিক। দর্শন এবং মনস্তত্ত্ব ইমেজ বিশ্লেষণে এখানে প্রভাবী। এই গ্রন্থের লেখক আন্দ্রে বাজাঁ সম্ভবত প্রথম চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক। গত শতকের চল্লিশের দশক নাগাদ চলচ্চিত্রের ভাষা যে পরিণত স্থিতাবস্থা অর্জন করেছিল তার শৈলীভাণ্ডারের মহাগ্রন্থনা করেছিলেন তিনি। ইমেজ ধারণে, সম্পাদনার পছন্দে এবং শব্দ ও নিঃশব্দের ব্যবহারে কীভাবে চলচ্চিত্রিক বর্ণনা সম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল তার বিবরণ তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।
কাকে বলে সিনেমা? গ্রন্থে তার প্রস্তাব, তর্ক, সিদ্ধান্ত চলচ্চিত্রতত্ত্বের সূচনা করেছিল আজ থেকে সত্তর বছর আগে। সাত দশকের পরবর্তী যাত্রায় চলচ্চিত্র নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে; এই গ্রন্থ সকল পরিবর্তনের ভেতরে চিন্তাবীজ হিসেবে চলচ্চিত্রভাষার বিকাশকে পুষ্টি দিয়ে চলেছে। তার শক্তি ইতিহাস-চেতনায়, ভবিষ্যৎমুখী প্রেরণায় এবং চলচ্ছবির প্রতি নিখাদ ভালোবাসায়। -
সভ্যতার সংকট ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
গত শতকের চল্লিশের দশক নাগাদ শব্দ যুক্ত হওয়ার এক দশকের মধ্যে চলচ্চিত্র একটি সাধারণ ভাষায় স্থিত হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় সেই সব চলচ্চিত্রকারের অন্যতম যাঁরা এই সাধারণ ভাষায় তাঁদের চলচ্চিত্রকথা রচনা করেছেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি শুরু হয়ে প্রায় চার দশক ধরে নির্মিত হয়েছে ইমেজ-শব্দের এক ধনী ভাণ্ডার; সূক্ষ্ম সংবেদী চিত্রালাপ-ব্যক্তি আর সমাজ প্রসঙ্গে।
এখন, এই বছর, তাঁর জন্মশতবর্ষে পৌঁছে এইসব ছবি কি অতিক্রান্ত কোনো ধ্রুপদী নির্মাণ? আমরা, বাঙালিরা, উপমহাদেশের চলচ্চিত্রজন, কী সাজিয়ে রেখেছি এইসব আশ্চর্য সম্ভার আমাদের সন্তর্পণ কোনো চেতনে? যা হয় অনচ্ছ প্রেরণা এবং গর্বিত এক বোধ আমাদের চলচ্চিত্র-ইতিহাসের ভেতর থেকে উৎসারিত? না কি, সমকালের পাঠে তারা প্রাসঙ্গিক; প্রখর তারা রাজনীতি এবং ব্যক্তির বীক্ষণে; সামাজিক সংলাপে এবং ইতিহাস খননে? এইসব চিন্তা ক্রমাগত কাজ করে চলেছে এই গ্রন্থের হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়।
সত্যজিৎ রায়ের গল্প আর সংলাপের নুয়ান্স, সূক্ষ্ম ডিটেইলের কাজ, তাঁর ভারসাম্যময় কম্পোজিশন, সংযমী সম্পাদনা নিয়ে প্রচলিত মুগ্ধ উচ্চারণের বাইরে এই চলচ্চিত্রপঞ্জি নিয়ে আর কোনো পঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে কি প্রবেশ করা যায়? পুঁজিবাদী বিচ্ছিন্নতা, আরবান গেরিলাযুদ্ধ, বিশ শতকের নতুন তরুণের লিবিডো অথবা নাগরিকদের নৈতিকতার সংকট নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যায় কি? এসব খতিয়ে দেখতে দেখতে প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই গ্রন্থের নির্মাণ। চেষ্টা করা গেছে সত্যজিৎ রায়ের ধ্রুপদী ঐশ্বর্য এবং কালাতিক্রমী প্রাসঙ্গিকতার এক কম্পোজিট পাঠ উপস্থাপনের।